আগরতলার নাম শোনেনি এমন মানুষ কম আছে। বাংলাদেশের নিকটবর্তী ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী এই আগরতলা। রাজকীয় বাড়ি, জলের প্রাসাদ, বণ্য প্রাণীর অভয়ারণ্যের মত আরো অসংখ্য স্থাপনা দেখতে অনেক মানুষ ঢাকা থেকে আগরতলা ভ্রমণ করে। আমাদের আগরতলা ভ্রমণ গাইড পড়লে আপনি সহজেই দেশীয় আবহে মোড়ানো এই ঐতিহাসিক শহর দেখতে যেতে পারবেন। চলুন জেনে নেই কিভাবে আগরতলা যাবেন ও কোথায় ঘুরবেন।
আগরতলায় কি কি আবাসিক হোটেল রয়েছে?
আগরতলায় ভালো মানের হোটেল ভাড়া ৪,০০০ টাকা থেকে শুরু, যা হলিডে সীজন বা বিশেষ কারণে পরিবর্তিত হতে পারে। এর চাইতে কম ভাড়ার যেসব হোটেল রয়েছে সেগুলোর খুব একটা ভালো সেবা নাও পেতে পারেন। তবে শেয়ারট্রিপের ইনভেন্টরিতে আগরতলার যেসব আবাসিক হোটেল আছে সেগুলোতে সুন্দর সুযোগ-সুবিধা পাবেন।
আগরতলার সেরা হোটেলগুলো হলো:
- জিঞ্জার হোটেল আগরতলা
- হোটেল সিটি সেন্টার
- হোটেল সোনার তলী আগরতলা
- চারুলতা - দা বুটিক গেস্ট হাউজ
- হোটেল উডল্যান্ড পার্ক
- হোটেল প্যালেস ইন
- হোটেল এক্সিকিউটিভ ইন্
- রয়্যাল গেস্ট হাউজ
- হোটেল সমরাজ রিজেন্সী
যেভাবে আগরতলা যাবেন
বাংলাদেশে থেকে সড়ক, বিমান, ও রেলপথে আগরতলা যেতে পারবেন। সড়কপথে অনেক সময় লাগে। তবে বিমানে গেলে দ্রুত পৌছে আগরতলার সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থাপনাগুলো দেখার পর্যাপ্ত সময় পাবেন। রেলপথে গেলে এক দিনের মধ্যেই আগরতলা ঘুরে চলে আসতে হয়। তাই হাতে দুই-তিন দিন সময় নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে।
১. বিমানে ঢাকা থেকে আগরতলা ভ্রমণ
ঢাকা থেকে আগরতলা রুটে ডিরেক্ট কোন ফ্লাইট নেই। তাই চেন্নাই হয়ে ইন্ডিগো, ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, ও এয়ার ইন্ডিয়ার মাধ্যমে ঢাকা থেকে আগরতলা যেতে পারবেন। আর শেয়ারট্রিপ থেকে রিটার্ন টিকেটসহ ফ্লাইট বুক করলে যাওয়া আসা সহ সর্বনিম্ন ১৮ হাজার টাকা খরচ হবে। শেষ মুহুর্তে টিকেট কিনলে বা বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণ করলে এর দাম আরো বাড়বে।
ট্রেনের তুলানায় বিমানের মাধ্যমে সবচেয়ে কম সময়ে আগরতলা যেতে পারবেন। বিমান বাংলাদেশের মাধ্যমে ঢাকা থেকে চেন্নাই গিয়ে এয়ার ইন্ডিয়ায় চেন্নাই থেকে আগরতলা গেলে সবচেয়ে কম সময় লাগোবে, যা মাত্র ৬ ঘন্টা। কিন্তু এই ক্ষেত্রে টিকেট প্রাইস ও অনেক বেশী, প্রায় ৩২,০০০ টাকার মত। তবে ইন্ডিগো কিছু কিছু সময়ে যেদিন ঢাকা থেকে চেন্নাই যায় সেদিন-ই চেন্নাই থেকে আগরতলা যায়, আর সেক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ হাজার টাকার মত এবং সময় লাগে ৮-১০ ঘন্টা। যদি বাজেট একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে দাড়ায় তাহলে এটাই আপনার জন্য বেস্ট ডিল হবে।
২. রেলপথে ঢাকা থেকে আগরতলা ভ্রমণ
রেলপথে যেতে হলে কমলাপুর থেকে ৭ঃ৪৫ টায় মহানগর প্রভাতী ট্রেনে উঠতে হবে। এরপর আখাউড়া রেলস্টেশনে নেমে আখাউড়া স্থলবন্দর চেকপোস্টে পৌছানো লাগবে। এখানে সোনালী ব্যাংকের বিশেষ বুথে ট্যাক্স পেমেন্ট করে ১৫ থেকে ২০ মিনিটে ইমিগ্রেশন সম্পূর্ণ করে ভারতে যেতে পারবেন। সীমান্তের ওপাশে আগরতলা চেকপোস্টে ইমিগ্রেশণ ফর্ম পূরণ করে মিনিট কয়েক হাঁটলেই আগরতলার দেখা মিলবে।
আগরতলার সেরা ভ্রমণ স্থান সমূহ
বাংলাদেশের সাথে কথাবার্তা, আচার আচরণে আগরতলার অনেক মিল আছে। সংস্কৃতি ও রাস্তাঘাটও অনেকটা একইরকম। তাই এখানকার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো আপনাকে পুরনো বাঙালি ঐতিহ্যকে সরাসরি দেখার সুযোগ করে দেবে। আজকের আগরতলা ভ্রমণ গাইডে আমরা এমন ১০টি স্থানের তালিকা করেছি যা না দেখলে আগরতলা ভ্রমণ অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে।
আগরতলার সেরা ১০টি ভ্রমণ স্থানঃ
১. কুঞ্জবন প্রাসাদ
হিলটপ রিট্রিটের জন্য কুঞ্জবন প্রাসাদ বা পুষ্পবন্ত প্রাসাদ সেরা একটি স্থান। ১৯১৭ সালে সহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর এটা নির্মাণ করেন। প্রাসাদে চারপাশে সবুজে ঘেরা গাছপালার মাঝে বিস্তৃত একটা মাঠ আছে। ফাকা জায়গা থেকে প্রশস্ত প্যানারমিক ভিউ পাবেন। চাইলে আশেপাশের মানুষ বা গাইডের মাধ্যমে প্রাসাদ তৈরির ইতিহাসও জেনে নিতে পারেন। প্রাসাদের একটি ঘরে পুরনো ছবি, হাতির দাঁতের শিল্প, রাজবংশের পুরনো ছবিসহ অনেকরকম পুরনো আসবাপত্র আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জহরলাল নেহেরুসহ অনেকেই এই প্রাসাদে থেকেছেন। কৃষ্ণনগরের রাজভবন এলাকায় গেলেই প্রাসাদের দেখা মিলবে।
২. জগন্নাথ মন্দির
আগরতলার উজ্জয়ন্ত প্যালেস গ্রাউন্ডে অবস্থিত জগন্নাথ মন্দির। তীর্থযাত্রীসহ সব ধর্মের মানুষেরা মন্দিরটি পছন্দ করেন। আয়তনের খুব বড় না হলেও আটকোণার নকশায় করা মন্দিরটি দেখতে বেশ মনোরম লাগবে। ভারতীয় স্থাপত্যকলার ইতিহাসের সাক্ষী মন্দিরটি। এখানে প্রত্যেক কোণায় একটি করে স্তম্ভ আছে। চূড়ায় বিভিন্ন দেব-দেবী ও লতাপাতার চিত্রকর্ম দেখতে পাবেন। এছাড়া মূল মন্দিরের সামনে বাহক সিংহ, হাতি ও ঘোড়ার বেশ কিছু মূর্তি রয়েছে। মন্দিরে প্রতিমা ও লোহার শিকে ঘেরা একটা পুকুরও আছে। এছাড়া ভোজনশালা, বাগান ও ফুলের চত্বর আপনাকে বেশ মানসিক প্রশান্তি দেবে। আগরতলার ইন্দ্রনগরে গিয়ে মন্দিরটি দেখে আসতে পারেন।
৩. উনাকোটি
পাথরে তৈরি এক প্রাকৃতিক বিষ্ময় উনাকোটি। তিব্বত-বর্মী আদিবাসীরা এটাকে খুবই পবিত্র স্থান মনে করেন। এখানে পাথরের গায়ে হিন্দু দেব-দেবীর অনেক মূর্তি খোদাই করা আছে। শিবের মূর্তিটি কমপক্ষে ৩০ ফুট লম্বা। এছাড়া উনাকোটির পাশেই উদয়ন বুদ্ধ বিহার আছে। এখানে চার ধরনের ধাতুর তৈরি ৩০০ কেজি ওজনের মূর্তি আছে। পাশে রাজপরিবারের সহায়তায় তৈরি লক্ষ্ণী নারায়ণের মন্দিরও দেখতে পাবেন। প্রকৃতি ও ধর্মীয় পরিবেশ এখানে দারুণ এক শান্তির্পূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখে। ভাস্কর্য দেখতে দেখতে কখন যে সময় পার হয়ে যাবে টেরই পাবেন না।
৪. ডম্বুর লেক
সবুজ পাহাড়ের মধ্যে নদীর মত দেখতে একটি জলপ্রপাত হলো ডম্বুর লেক। এখানকার পানি খুবই পরিষ্কার। আগরতলা থেকে লেকটি দেখতে অনেকটা ড্রামের মত। অনেকে পিকনিক করতে এই লেকে যায়। লেক থেকে দূর-দিগন্তে সূর্যাস্তের বিরল দৃশ্য দেখা যায়। প্রতি বছর জানুয়ারিতে এই লেকের পাশে পৌষ সংক্রান্তি মেলা অনুষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থেকে দর্শানার্থীরা মেলা দেখতে আসে। লেকের চারপাশে বণ্য প্রাণীর অভয়ারণ্য, দেবতামূড়া পাহাড়, লংথারাই মন্দির, জসি প্ল্যান্ট ও কমলেশ্বরী মন্দিরসহ আরো কিছু স্থাপনা রয়েছে। লেকটি দেখতে হলে ত্রিপুরার ডম্বুর নামক স্থানে যেতে হবে।
৫. বেণুবন বিহার
আগরতলার বেণুবন বিহার বেশ জনপ্রিয় একটি বুদ্ধ বিহার। স্কুল কলেজের বিভিন্ন বইতে এই বিহারের উল্লেখ আছে। প্রতি বছর এখানে মহা কঠিন চিবর বা বস্ত্র দান উৎসব হয়। ঐতিহাসিকেরা বলেন এখানে এক রাতের মধ্যেই সূতা থেকে কাপড় তৈরি করে সেগুলো বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দেওয়া হতো। বিহার ঘিরে অনেক গাছপালা আছে, তাই বেশ নীরব ও সতেজ পরিবেশ বিরাজ করে। বুদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মের মানুষেরা ও এখানে গিয়ে মানসিক প্রশান্তি নিতে পছন্দ করে। আগরতলার কুঞ্জবনে পৌছে এখানে যেতে পারবেন।
৬. সিপাহীজলা অভয়ারণ্য
ত্রিপুরার অন্যতম সিপাহীজলা অভয়ারণ্যে বণ্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ দেখতে পারবেন। আগরতলা থেকে একটু দূরে বিশালগড় গেলে এখানে যেতে পারবেন। প্রায় ২০ বর্গ কিলোমিটারের মত বড় এই জায়গাতে কৃত্রিম হ্রদ, বোটানিকাল গার্ডেন ও জাদু বাগান আছে। এখানে বেশ কিছু দুর্লভ পাখি ও চিতাবাঘ রয়েছে। এছাড়া বানর, লঙ্গুর, মুঙোয় সহ অনেক বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর দেখা মিলে। এখানে থাকার জায়গা ও চিড়িয়াখানাও দেখতে পাবেন। অনেকে অ্যাডভেঞ্চারের জন্য আবাশারিকা নামের ডাক বাংলোতে অবস্থান করে। এখানকার ওয়াচ টাওয়ার থেকে দূরের দৃশ্যের পাশাপাশি অভয়ারণ্যের প্রাণীর অবাধ বিচরণ দেখা য়ায়।
৭. উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ
এটি ত্রিপুরা রাজ্যের প্রাক্তন প্রাসাদ। একসময় রাজকার্য পরিচালিত হলেও এটি এখন একটি জাদুঘরের রূপান্তর করা হয়েছে। ১৮৯৯ সালে রাজা কিমোর মাণিক্য দেব প্রাসাদটি নির্মাণ করে। এটি ইন্দ্রনগরের প্যালেস কম্পাউন্ডে অবস্থিত। এখানে ২৫০ একর জায়গা জুড়ে সিংহাসন কক্ষ, দরবার হল, পাঠাগার, অভ্যর্থনা কক্ষসহ নানারকমের কারুকার্য রয়েছে। প্রাসাদে একটা ৮৬ ফুট গম্বুজ আছে যা দেখতে বেশ আকর্ষণীয়। এছাড়া একটা বড় বাগানের দুপাশে ফোয়ারা দেওয়া কৃত্রিম পুকুর দেখবেন। একসাথে মুঘল, রোমান ও ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণ দেখতে হলে এখানে যেতে পারেন।
৮. জাম্পুই হিলস
আগরতলা থেকে বেশ খানিকটা দূরে অবস্থিত জাম্পুই হিলস। সমুদ্র থেকে ৩০০০ ফিট উঁচু এই পাহাড়। প্রতিবছর অরণ্য উৎসব দেখতে হাজার হাজার মানুষ এখানে ভিড় করে। পাহাড় থেকে সবসময় ভাসমান মেঘ দেখা যায়। এখানে থেকে সকালে খুব মনোরম সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখতে পারবেন। পাহাড়ের মিজোরাম উপত্যকা থেকে অনেক দূর দূরান্তের প্যানারোমিক ভিউ পাওয়া যায়। তাই ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফারদের জন্য এটা সেরা জায়গা। এখানে ইডেন পর্যটন লজ নামে একটা থাকার হোটেল আছে। পরিবার নিয়ে ছুটি কাটাতে গেলে গেলে রিয়াম ও সিকাম আদিবাসী গোষ্ঠীর অনেকরকম পাহাড়ি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে পারবেন।
৯. নীরমহল
আগরতলা থেকে প্রায় ৫০ কিমি দূরে নীরমহল নামে এই প্রাসাদটি দেখতে পাবেন। ১৯৩০ সালে রাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য এটি নির্মাণ করেন। রুদ্রসাগর লেকের মাঝে হবার জন্য প্রাসাদটিকে পানিতে ভাসমান মনে হয়। দর্শনার্থীরা এখানে হিন্দু ও মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর মিলনমেলা দেখতে যায়। পুরো প্রাসাদটি দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। একটি অন্দরমহল, যেখানে রাজপরিবারের আবাসস্থল ছিল। আরেকটি হলো বিনোদনশালা, যেখানে বিভিন্নরকম থিয়েটার, নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। এখানে সব মিলিয়ে ২৪ টি কক্ষ ও বিভিন্ন রকম ফুলের বাগান আছে। আগরতলা থেকে রুদিজলা নামক স্থানে গেলে প্রাসাদটি দেখতে পারবেন।
১০. কমলা সাগর লেক
পঞ্চদশ শতাব্দীতে মহারাজা ধন্য মানিক্যের হাতে তৈরি হয় এই কমলাসাগর লেক। এটা বাংলাদেশ সীমান্তের বেশ কাছে অবস্থিত। লেকটি বেশ জাকজমকপূর্ণ। লেকের কাছেই একটা বিখ্যাত কালী মন্দির আছে। প্রতিবছর এপ্রিল ও আগস্টে এখানে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বিশাল মেলা দেখতে দূর দূরান্ত থেকে লাখো মানুষের ঢল নামে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য এখানে ভ্রমণার্থীরা পিকনিক করতে অনেক পছন্দ করে। আগরতলা থেকে মাত্র ৩০ কিমি দূরে গেলে কমলাসাগর লেকে যেতে পারবেন।
শেয়ারট্রিপের সাথে আগরতলা ভ্রমণ হব আরও সুন্দর!
আগরতলা বাংলাদেশের বেশ কাছে হবার কারণে যাতায়াতে কোনো প্রকার সমস্যার সম্ভাবনা নেই। শেয়ারট্রিপ থেকে ভ্রমণ প্যাকেজ নিয়ে দু বা তিনদিনের ট্রিপে এখানকার সকল স্থাপনা ও প্রাকৃতিক নিঃসর্গ দেখতে পারেন। এছাড়া আগরতলা ভ্রমণ গাইড বিষয়ে যেকোনো ধরনের সহায়তা পেতে কল করুন +8809617617617 নম্বরে অথবা ইমেইল করুন vacation@sharetrip.net-এড্রেসে।